৩০ ডিসেম্বর ২০১৩

সাঁদা লোমের চড়ুই



মানুষ না হলে কি হবে? ওদেরও দুই পা আছে। ওরাও টিনের চালের নিচে নিজেদের বাসা বেঁধেছে।
হ্যাঁ চড়ুই দম্পতি। খড়ের তৈরী ছোট্ট ঘর ওদের। প্রথম যখন ওদের দেখা হয়েছিল তখন ছিল ভরা বৃষ্টির দিন। মেয়ে চড়ুইটি খাবার আনতে যাচ্ছিলো। পথিমধ্যেই বৃষ্টি। কি আর করা? উপায় না দেখে ধারে কাছেই একটা দোতলা বিল্ডিংয়ের বেলকনিতে উঠতে হল তাকে। উফঃ যাক বাঁচা গেলো বোধ হয়। গা ঝাড়া দিয়ে বৃষ্টির পানি ফেলে দিল নিজের পালক থেকে। এখন শুধুই অপেক্ষা,কখন বৃষ্টি থামে? এদিক ওদিক তাকাতে চোখে পড়ল বেলকনিরই একটু দূরে বসে আছে আরেকটা চড়ুই। একটা ছেলে চড়ুই। একদৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছে। আর কোন দিকে খেয়াল নেই। তার পাশে যে একটা মেয়ে চড়ুই একা বসে আছে তার খেয়ালও করছে না। ছেলে চড়ুইটিকে দেখতে লাগল মেয়ে চড়ুইটি। উমম হ্যান্ডসাম বলা চলে না তবে মন্দ না। দৈহিক অবয়বে একটা পৌরষত্ব আছে। দৃপ্ত পায়ে বেলকনির গ্রিল ধরে বসে আছে। নির্বিকার দৃষ্টিতে সামনে তাকানো,যেন আকাশের শেষ খুজছে। মাথার উপর একগুচ্ছ সাঁদা পালক। বাতাসে মৃদু মৃদু কাঁপছে। এক নজরে বলতে গেলে ছেলে চড়ুইটি মন্দ না। একা একা আর কতক্ষন বসে থাকা যায়? উফঃ এই টাইপের ছেলে গুলো এমন কেন হয়? মেয়েদের দেখলেই না দেখার ভান করে। আর কতক্ষন অপেক্ষা করা যায়? যাক অপরিচতই তো একটু আলাপ সেরে নেয়া যাক। আর কোন দিন দেখা নাও হতে পারে। এই ভেবে ছেলে চড়ুইটার একটু ধারে যেয়ে পাখা ঝাপটা দিল মেয়টা। এতক্ষনে মেয়ে চড়ুইটিকে খেয়াল করল ছেলে চড়ুইটি। ছেলে চড়ুইটি তবুও নির্বিকার। মেয়ে চড়ুইটা এবার তার বিব্রত ভাব বজায় রেখে ধৈর্য্যর বাধ ভেঙে কিচির মিচির করে বলেই ফেলল-
– কি বৃষ্টি তাই না? আ…আপনি কি এখানেই থাকেন?
– হুমম।জ্বী না।
এছেলে গম্ভীর প্রকৃতির। বোঝা হয়ে গেলো তার। হঠাত্ এক দমকা বাতাসে একটা পাতা এসে লাগলো ছেলেটার মাথায়। একটা চড়ুইয়ের তুলনায় বড়ই বলা চলে পাতাটাকে। মাথায় ব্যাথা পেলো বোধহয়। মাথা নিচু করে তারপরও নির্বিকারভাবে বসে আছে ছেলে চড়ুইটি। এত নির্বিকার হওয়ার কি আছে? মেয়ে চড়ুইটি এবার একটু বিব্রতই হলো। তবে খারাপও লাগছে।
– ইশশ। খুব লাগলো বুঝি? পাতাটা যে আসছে আপনি দেখতে পান নি? মাথাটা নোয়ালেই পারতেন।
– জ্বী আমি বাম চোখে দেখি না। ওটা অকেজো।
মৃদু হেসে খুব নির্বিকার ভাবেই বলল ছেলে চড়ুইটি। মেয়ে চড়ুইটি এতক্ষন ছিল ছেলেটির ডান পাশে। তাই বাম চোখ খেয়াল না করারই কথা। ছেলেটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কোথায় যেন হারিয়ে গেল মেয়ে চড়ুইটি। জ্ঞান ফিরে পেতেই তার ছোট্ট মনটি কেন যেন হু হু করে উঠলো। উড়ে এসে ছেলেটির ডান পাশে বসলো। কালসিটে হয়ে আছে চোখটা। তবে ভালো করে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। বাতাসে মৃদু কেঁপে উঠছে মাথার সাদা লোম গুলো। মেয়টির দৃষ্টি এখন আর ছেলেটির চোখে নয়,কম্পমান লোম গুলোতে। কি যেন আছে ওখানে। বৃষ্টি থামারও লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। মেয়ে চড়ুইটি এবার একটু সরে আসলো,আলাপ জমানোর চেষ্টায়-
– কি হয়েছিল?
– মানুষের দান। এক বাচ্চা ছেলের গুলতির আশির্বাদ।
মানুষের প্রতি কিছুটা অবজ্ঞার স্বরেই বলে উঠলো ছেলে চড়ুইটি। মুখে মিষ্টি হাঁসি থাকলেও মনে আছে মনুষ্যজাতের জন্য অগাধ তিক্ততা।
মেয়ে চড়ুইটি বুঝতে পারে। তাই আর এ প্রসঙ্গে কথা বাড়ায় না। অন্য কথায় চলে যায়। চলতে থাকে তাদের কিঁচির মিঁচির। বাইরে বৃষ্টির থামারও লক্ষন নেই। এভাবেই তাদের সংসারের শুরু। স্বামী হিসেবে একদম যথার্থ ছেলে চড়ুইটি। দায়িত্বে অবহেলাও করে না। ছেলে চড়ুইটি যখন বাইরে খাবার সংগ্রহ করে তখন মেয়েটি নিজের বাসা পরিপাটিতে ব্যাস্ত। বাসাটাকে নতুন করে সাঁজাতে হবে তো। ওরাতো এখন আর দুজন নেই, চার জন হতে চলেছে। ছেলে চড়ুইটি বাসায় ফিরেছে,খাওয়ার পর্বও শেষ। এখন শুধু বসে থাকা আর দুজনে মিলে কিঁচির-মিঁচির করা। ছোট্ট খড়ের বাসাটার মধ্যে দুজনে বসে আছে,সামনে ডিম দুটো। আহা এই বুঝি সুখ। কিন্তু সুখ বুঝি খুবই স্বল্প মেয়াদী বস্তু। চাইলেও ধরে রাখা য়ায় না। ডিম ফুটে বাচ্চা দুটো বের হয়েছে গত চারদিন আগে। আগের মতই চলছিল তাদের ছোট্ট সংসার। একদিন যখন ছেলে চড়ুই এবং মেয়ে চড়ুই ঘরে ছিল না তখন বড় ছানাটি দুঃভাগ্যক্রমে পড়ে যায় খড়ের তৈরী ঠুনকো বাসাটি থেকে। আর যায় কোথা?শিকার হলো এক মানব শিশুর খেলনা হিসেবে। দিনশেষে যখন চড়ুই ছানাটির প্রাণ প্রায় যায় যায় অবস্থা তখনই তাকে জবাই করে দেয়া হয় খাওয়ার উদ্দেশ্যে। খেলা করেও বুঝি তাদের স্বাদ মিটলো না এখন খেতে হবে। ঝলসানো চড়ুই ছানাটি যখন মানব সন্তানের গরম ভাতের প্লেটে ধোঁয়া উঠাচ্ছে তখন চড়ুই পিতা এবং মাতা অসহায় চোখে সে দৃশ্য দেখছে। এজন্যই মনে হয় ওদের জন্ম। পরিবেশের বাস্তুসংস্থানকেটিকিয়ে রাখার জন্যই হয়তো ওদের এই পৃথিবীতে আসা। এই শেষ নয়। তারপরও ভালই দিন কাটছিল তাদের। কিন্তু বিধিবাম।একদিন ছেলে চড়ুইটির হদিস মিলছে না। রাত হয়ে গেল তবুই ফিরছে না। মেয়ে চড়ুইটির অপেক্ষার পালা যেন শেষই হচ্ছে না। পরেরদিন সকালেও খোঁজ না পেয়ে এবার নিজেই খুঁজতে চলে গেল সে। উড়তে উড়তে পুরো শহরটাই যখন দেখা শেষ তখন কোন এক ইলেকট্রিকের তারে উলটো হয়ে ঝুলতে দেখলো একটি চড়ুই পাখিকে। চিনতে কষ্ট হলো না তার। মৃত চড়ুই পাখিটির মাথার উপরের সাঁদা লোমগুলো এখনও মৃদু মৃদু কাঁপছে। রাস্তার মানুষ গুলো হেঁটে যাওয়ার সময় দেখছে একটি মৃত চড়ুইয়ের পাশে আরেকটি চড়ুই বসে কিঁচির মিঁচির করছে। শুধুই কি কিঁচির মিঁচির? নাকি বিলাপ করা কান্নার সুর ওটা? মানুষের কি সাধ্য সেটা বোঝার? কিঁচির মিঁচির রূপি বিলাপ যখন চিঁ চিঁ তে রুপান্তর নিল তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ইচ্ছা থাকলেও,মৃতদেহটির পাশে আর বেশিক্ষন থাকা হল না তার। ঘরে যে এখনো আরেকটি ছানা বেঁচে আছে। খাবার নিতে হবে তো ছানাটির জন্য। এই ছানাটিই যে তার এখন একমাত্র বেঁচে থাকার সম্বল। চড়ুইয়ের এই ছোট্ট মনে এখন দুঃখেই পরিপূর্ণ। তবে বাসায় থাকা ছানাটি এখন তার একমাত্র আশা। যে আশার কারনে এখন তাকে দুঃখ ভুলে থাকতে হবে। কিন্তু সে কি পারবে, খাদ্য সংগ্রহের পথে যেতে যে দোতলা বেলকনি আজও দেখা যায় সেটা দেখেও সবকিছু ভুলে থাকতে? বৃষ্টির দিনগুলোতে চুপ করে থাকার উপায় কি তার? কোন এক বৃষ্টিতেই তো তার জীবনে সুখের ছোঁয়া লেগেছিল. . . .


ණ รเทนร