০৪ এপ্রিল ২০১৮

ন্যাচারস্ ইকুয়ালিটি


— একি গায়ে পড়ছেন কেন?
— চলন্ত বাসে গায়ে গা তো লাগবেই। আপনার অভিযোগ ড্রাইভারকে বলুন।
— চেঁপে বসুন! একটা মেয়ের সাথে কি রকম আচরণ করতে হয় শেখেন নি নাকি?
— হুমম? জ্বী না। এরকম কোন কোচিং সেন্টার আছে কি? থাকলে ঠিকানাটা দিন। আজই ভর্তি হয়ে যাই।
— উফ্ফ। ডিসগাস্টিং! ম্যানারলেস কোথাকার।
— (নিশ্চুপ)
— আমি বলে ছেড়ে দিয়েছি।নেক্সট টাইম আর কোন মেয়ের সাথে এরকম করবেন না। মাইন্ড ইট।
— (নিশ্চুপ)
— একি চুপ করে আছেন কেন? কথা বলুন!
— কি বলবো?
— আমার মাথা বলবেন। আপনি সাঁদা শার্ট পড়েছেন কেন? আপনাকে বয়স্ক বয়স্ক লাগছে।
— সামনে যেটা পেয়েছি সেটা পড়েই চলে এসেছি। খেয়াল করিনি তাই,,
— কেন? খেয়াল থাকে কোথায়? রাস্তার মেয়েদের দিকে?
— (নিশ্চুপ)
— আপনি যাবেন কোথায়?
— ঠিক নেই। বলতে পারছি না।
— আপনি এরকম কেন? একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে গেলে যে মধুমাখা কথা বলতে হয় জানেন না? নাকি আপনার মধ্যে রস বলে কিছু নেই?
— জ্বী? আসলে স্কুল জীবন থেকেই রসায়ন সাবজেক্টটার প্রতি আমার অনীহা কাজ করে।
— উফ্ফ! আপনার সাথে কথা বলাই উচিত হয় নি আমার। আপনি একটা অসামাজিক ব্যাক্তি।
— (নিশ্চুপ)
— আপনি আমার পাশ থেকে উঠে বসুন। না থাক, আমিই উঠছি। যত্তসব!

হঠাত্‍ করেই ড্রাইভার ব্রেক কষলেন। প্রায় পড়তে পড়তে একটা সিট ধরে নিজেকে সামলে আবার আগের সিটেই বসে পড়তে হলো নিহিতা কে,

— উফ্ফ! এই ড্রাইভারটাও একটা স্টুপিড। মনে হচ্ছে যেন মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।
— (নিশ্চুপ)
— আরেকটু হলেইতো আমি পড়ে যচ্ছিলাম। আপনি ধরলেন না কেন? একটা মেয়ে বিপদে পড়লে যে তাকে সাহায্য করতে হয় জানেন না?
— জ্বী?? আপনার গায়ে গা লাগার জন্যে একটু আগেইতো আমাকে ধমকালেন। ম্যানারলেস বল্লেন। আর এখন যদি ধরতাম তাহলে তো মনে হয় আমাকে ইভটিজার বলে জেলে দিতেন।
— উফ্ফ। হৈছে হৈছে। বুঝলাম তুমি অনেক নাটক করতে পারো। এক বছর ধরে তোমার নাটক দেখে আসছি। এখন থামো। একটু ভালো করে কথা বলোতো।
— কি বলবো?
— আজব! একটা মেয়েকে কিভাবে ইমপ্রেস করতে হয় তাও জানোনা নাকি? এমন এমন কথা বলবা যা শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে যাবো।
— (নিশ্চুপ)
— কি? আজও চুপ করে থাকবা? তোমার বন্ধুদের কাছে নাকি আমাকে নিয়ে সারাদিন ঘ্যান ঘ্যান করো? ওদের নাকি বলো যে তুমি সারাদিন আমাকে নিয়েই ভাবো। তো এখন চুপ কেন? এক বছর ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি। ইডিয়ট এটাও জানো না যে প্রেমের অফার ছেলেরা আগে দেয়, মেয়েরা না।
— নিহিতা। আরেকটু পরেই আমার স্টপেজ আসবে। আমি নেমে যাবো। একটু চাপুন।
— তুমি আমার সাথে এরকম করতেছো কেন শ্রাবণ? আমি কি কোন অন্যায় করছি? তোমাকে কি খুব কষ্ট দিয়ে ফেলছি? নাকি খুব বেশিই অধিকার ফলিয়ে যাচ্ছি তোমার উপর। হ্যাঁ, মনে হয় সেটাই করে ফেলছি আমি। আচ্ছা আমারই ভুল হৈছে। মাফ করে দিও। আমিই নেমে যাচ্ছি। আর জীবনেও তোমার সামনে আসবো না। এ মুখ দেখাবোনা।

কনড্রাক্টরকে বাস থামাতে বলে, চোখের কোণে একফোঁটা কান্না নিয়ে বাস থেকে নেমে গেল নিহিতা। পিছু ডাকলো না শ্রাবণ। কেন যেন শক্তি পাচ্ছে না ডাকার। ওর মত একটা ভ্যাগাবন্ডের জীবনে নিহিতার মত একটা মেয়ে বেমানান ব্যাপার। বাস থেকে নেমে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো নিহিতা। বাসটা তার পাশ দিয়েই চলে যাচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পরই একটা ইউটার্ন। বাসটা যখনই ইউটার্ন নিতে যাবে ঠিক তখনই বিপরীত পাশ থেকে আগত আরেকটি বাসের আকষ্মিক সংঘর্ষ। বিকট শব্দের কারনে কিছুক্ষনের জন্য হতবাক হয়ে যায় রাস্তার মানুষেরা। দূর্ঘটনাটি তেমন মারাত্মক ছিল না। তবে আকষ্মিক সংঘর্ষের কারণে বাসের দরজা দিয়ে ছিঁটকে পড়ে অপর একটি গাড়ির চাকার তলায় পৃষ্ট হয় একজন।একটু পিছেই হাঁটছিল নিহিতা। দূর্ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে ছিল কিছুক্ষন। আকস্মিকতা কাটতেই মনে পড়ল, আরে ঐ বাসে তো শ্রাবণও বসা ছিল। হাতে থাকা বইগুলো পড়ে যায় নিহিতার। কিছু না ভেবেই দৌড় দেয় দূঘর্টনার জায়গায়। গিয়ে দেখতে পায় অনেক মানুষ জমে আছে সেখানে। রাস্তায় পড়ে আছে একটা রক্তাক্ত দেহ। মৃতদেহটির পরনে সাঁদা শার্ট যা এখন রক্তে লাল হয়ে আছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না নিহিতা। এটা কি শ্রাবণ? না তা কি করে হয়? শ্রাবণ এভাবে কিছু না বলে চলে যেতে পারে না। নিহিতার বিশ্বাস ছিল শ্রাবণ একদিন হলেও তার কাছে আসবে। হিসেবটা মেলাতে পারছে না নিহিতা। দাড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও পাচ্ছে না। হঠাত্‍ করেই নিজের বাম কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করে নিহিতা। হাতটা শ্রাবণের। বিদ্ধস্ত অবস্থায় দিড়িয়ে আছে শ্রাবণ। আবারও হতবাক হওয়ার পালা নিহিতার। শ্রাবণ এখানে তাহলে মৃতদেহটি কার? পরক্ষণেই মনে পড়ে নিহিতার, আরে হ্যা, শ্রাবণতো সামনের সিটে ছিল না। বাসের মাঝামাঝি বসা ছিল ওরা। তাহলে ঐ লাশটা আরেকজনের? আর কিছু ভাবতে পারছে না নিহিতা। ভাবতে চায়ও না সে। নিজের মনের অজান্তেই জড়িয়ে ধরে শ্রাবণকে। শ্রাবণের সাঁদা শার্টটি রক্তে ভেজা ছিল না, তবে এখন ভিজছে, নিহিতার চোখের পানিতে। শ্রাবণ কিছু বলে না। সেও জড়িয়ে ধরে নিহিতাকে। কিরকম যেন একটা শক্তি অনুভব করছে শ্রাবণ। নিজেকে এখন একজন দায়িত্ববান পুরুষ বলে মনে হচ্ছে তার। আরও শক্তিশালী বাহুবন্ধনে জড়িয়ে নিহিতাকে বুকের উপর চেপে ধরে শ্রাবণ। কেমন যেন মনে হতে থাকে তার। মনে হচ্ছে যেন, যত যাই আসুক এ বাহুবন্ধন এখন আর ঢিল করা যাবে না। আর চুপ থাকা যাচ্ছে না। এবার শ্রাবণের পালা। শ্রাবণ একনাগারে বলে যেতে থাকলো,,

— নিহিতা, প্রথম যখন তোমাকে ক্যাম্পাসে দেখি ঠিক তখন থেকেই কেমন যেন বদলে গেল আমার মন।সারাক্ষণ তোমাকে নিয়েই ভাবতাম। কিন্তু সাহস হয়নি তোমাকে বলার। তুমিতো জানোই যে আমি একটা ইরেসপন্সিবল ভ্যাগাবন্ড ছেলে। কি করে তোমাকে বলতাম যে, তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি। তবে আজ আর আমি চুপ থাকবো না নিহিতা। সৃষ্টিকর্তা আজ হয়তো এই পরিবেশের সৃষ্টি করেছেন,আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তোমাকে একটা কথাই বলার জন্য যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি নিহিতা। অনেক অনেক।

নিহিতার কান্নার রেশ মুছে যায়নি এখনও। কান্নারত অবস্থাতেই মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানায় সে।
***

“প্রকৃতি বড়ই অদ্ভুত। যেখানে জীবনের সমাপ্তি ঘটে, সেখান থেকেই নতুন একটি জীবনের সূচনা করাই তার কাজ। ন্যাচার অলওয়েজ প্রেফারস ইকুয়ালিটি”